বকেয়া পরিশোধ ও বন্ধ পাটকল-চিনিকল চালুর দাবি

প্রকাশ : ২১ মে ২০২২, ২৩:০৮

সাহস ডেস্ক
বন্ধ পাটকল-চিনিকল চালু ও তার বিকাশে আমাদের প্রস্তাব শীর্ষক সেমিনার। ছবি: সাহস

২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেটে দেশের মৌলিক শিল্প রক্ষায় বন্ধ পাটকল-চিনিকল চালু ও তার বিকাশে আমাদের প্রস্তাব শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাটকল রক্ষায় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্যের উদ্যোগে শনিবার (২১ মে) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সেন্টারের নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজিত সেমিনারে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ও চিনিকল রাষ্ট্রীয় ভাবে চালু করার জোর দাবি জানানো হয়েছে এবং ৭ দফা দাবি প্রস্তাব করা হয়েছে।

দাবি গুলো হলোঃ ১. মাথা ভারি প্রশাসনের আকার ছোট করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ২. পাটকলগুলিকে অতিদ্রুত আধুনিকায়ন করে চালু করতে হবে এবং এক্ষেত্রে ধারাবাহিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। ৩. রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলিকে সচল করার জন্য এককালীন বরাদ্দ দিতে হবে। ৪. সরকারি দপ্তরের সকল সেক্টরে পাট জাত দ্রবের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সেগুলোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের পাটজাত পণ্য কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ৫. সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের পাট শিল্পকে বিকশিত করার জন্য একটা মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। ৬. বিএসএফআইসির হিসাব অনুযায়ী, মাড়াই স্থগিত মিলগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৫.৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। মিলগুলো বসিয়ে না রেখে এবং যন্ত্রপাতি নষ্ট হতে না দিয়ে অবিলম্বে মিলগুলো চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। এবং ৭. বকেয়া বেতন ভাতা (৩১.১১ কোটি টাকা), পিএফ বকেয়া (১১১.৬৩ কোটি টাকা), প্র্যাচুইটি বকেয়া (২৮৪.৫০ কোটি টাকা) অবিলম্বে পরিশোধ করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ দিতে হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে সময় যত বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সংখ্যা ততো কমেছে। ১৯৭২ সালে বিজেএমসির প্রতিষ্ঠাকালে প্রতিষ্ঠানটির আওতায় ৭০টিরও বেশি পাটকল ছিল। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ২০২০ সালে এসে অবশিষ্ট থাকে মাত্র ২৬টি পাটকল। যা ২০২০ সালের ২রা জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে একযোগে বন্ধের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। বিগত ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানের মুখ দেখেছে রাষ্ট্রয়াত্ব পাটকলগুলো। এই ৪৮ বছরে লোকসানের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে দুইশো কোটি টাকার কিছু বেশি। ক্রমাগত লোকসানের কারণে সরকারি পাটকল বন্ধ হলেও বেসরকারি পাটকলের ক্ষেত্রে চিত্রটা উল্টো। ক্রমাগত বেড়েছে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা। বর্তমানে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৮১টি। 

২০২০ সালের ২রা জুলাই পাটকল বন্ধের সময় পাটমন্ত্রী জানান, ২ মাসের মধ্যে সকল শ্রমিকদের সকল বকেয়া পাওনা পরিশোধ করে ৩ মাসের মধ্যে মিল চালু করা হবে। কিন্তু এখনো ৫ টি জুটমিলের ৮৪৬৩ জন অস্থায়ী শ্রমিকের কোনো পাওনা পরিশোধ হয়নি। বাকি জুটমিল গুলোর প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিকের বকেয়া এরিয়ার টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় হলেও এখনো শ্রমিকদের দেওয়া হয়নি। প্রতিটি মিলের ৫-৬ সপ্তাহের পাওনা বকেয়া আছে।

সেমিনারে উপস্থিত হওয়া বন্ধ পাটকল গুলোর প্রতিনিধিদের বক্তব্যে জানা যায়, দুই মাসের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করার কথা থাকলেও দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু পাঁচটি মিলের শ্রমিকেরা এখনো কোন টাকা পাননি। জীবন বাঁচানোর তাগিদে শ্রমিকদের অনেকেই এখন রিকশা চালাচ্ছেন। খাবার অভাবে ভিক্ষা করছেন অনেক শ্রমিক। দুর্নীতি ও অব্যাবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন তারা। এসময় প্রতিনিধিরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ ও পাটকলগুলো আধুনিকায়ন করে চালু করার দাবি জানান।

অন্যদিকে ২০২০ সালের শেষের দিকে রাষ্ট্রাত্ত্ব ৬টি চিনিকল বন্ধ করে সরকার। ২০২০ সাল থেকেই পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পঞ্চগড়, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এতে ২০২০-২১ অর্থবছরে চিনি উৎপাদন কমে উৎপাদনের পরিমাণ ৮২ হাজার টন থেকে নেমে ৪৮ হাজার টন হয়েছে, এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন কমে ২৪ হাজার টনে এসে নেমেছে। বাংলাদেশে যখন চিনি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ভারতে তখন চিনির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দেশের চিনির চাহিদা মেটাতে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের চাহিদা বৃদ্ধি ও দাম বেড়ে যাওয়ায় গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। এমন অবস্থায় চিনির দাম বেড়ে গেলে চিনি রপ্তানিতে ভারত কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে কিনা সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। এতে দেশে চিনির সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে চিনিকল গুলোর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, লোকসান কমানো এবং জনস্বার্থ বিবেচনায় এর বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সেমিনারে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন টিইউসির সভাপতি শহীদুল্লাহ্ চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, লেখক ও গবেষক মাহা মির্জা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারপারসন এবং অধ্যাপক এম এম আকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র দল (বাসদ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনের সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালাসহ বাংলাদেশের পাটকল চিনিকল শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।

সেমিনারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ পাটের বিশাল সম্ভাবনার দিকগুলো তুলে ধরে বলেন, এরকম একটি সম্ভাবনাময় এবং কৌশলগত খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে বেসরকারি মালিক নিশ্চিত ভাবে মুনাফার দিকেই যাবে। তাই এই খাতকে সরকারি মালিকানাতেই থাকতে হবে। সারা পৃথিবীতে পাটজাত শিল্পের চাহিদা দিন দিন বাড়বে। আসন্ন বাজেট তিনি পাটশিল্পকে জাতীয় শিল্প হিসেবে দাঁড় করার পরিপূরক বাজেট বরাদ্দ রাখার দাবি জানান।

লেখক ও গবেষক ড. মাহা মির্জা বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের ২০১০ সালের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেন, সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতে বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয়। সরকারি খাতকে বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া দেশের ৭৫টি সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে আর চালু করা যায়নি। কাজেই বেসরকারিকরণ করলেই শিল্পের বিকাশ হবে এবং প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরী হবে- বাংলাদেশের বেসরকারিকরণের ইতিহাস তা বলেনা।  দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলোকে যে ভর্তুকি দেওয়া হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয় রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও বিভিন্ন পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শিল্পের বিকাশের পেছনে থাকে রাষ্টের বিপুল প্রণোদনা। নিয়মিত রাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের বিপুল সংখক শিল্প প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করে টিকে আছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ অধ্যাপক এম এম আকাশ সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়ে বলেন, কারখনাগুলোতে লোকসানের কারণে ভর্তুকি না দিয়ে কাঁচামাল উৎপাদনের সময় কৃষক পর্যায়ে ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ও কাঁচামাল সহজলভ্য হবে। এতে কারখানাগুলোর উৎপাদন খরচ কমে যাবে এবং উৎপাদিত পণ্যগুলো মুনাফা সহ বাজারে বিক্রি করতে পারবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত