গান কবিতা নাটকে দেশব্যাপী ঝুমন দাসের মুক্তির দাবি

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:৫৭

ঝুমন দাসের মুক্তির দাবিতে আজ বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ঝুমন দাসের স্ত্রী রাই সরকার রাই ও তার ১১ মাস বয়সী ছেলে সৌম্য দাস। ছবি: উদীচী

কারাবন্দীত্বের ১৭৬তম দিনেও জামিন পাননি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঝুমন দাস আপন। কবিতা, গান আর পথ নাটকের সম্মিলনে তার মুক্তির দাবিতে আজ সারাদেশে এক যোগে প্রতিবাদি সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্টেটাস দেওয়া গ্রেপ্তার হন ঝুমন। এরপর শাল্লার হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়িতে ভাঙচুর ও তাণ্ডবযজ্ঞ চালায় মামুনুলের অনুসারীরা।

আজ বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে রাজধানীর শাহবাগ চত্তরে সমাবেশ আয়োজন করে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ছাড়াও সমাবেশে গণসংগীত পরিবেশন করে চারণ শিল্পীগোষ্ঠী। এছাড়া 'মোড়ল পুলিশিং' শিরোনামে নাটক ইন্ট্রোভাইজেশন করে প্রাচ্যনাট।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহকারী সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমামের পরিচালনায় কেন্দ্রীয় সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন। এছাড়া, সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ঝুমন দাসের স্ত্রী রাই সরকার রাই ও তার ১১ মাস বয়সী ছেলে সৌম্য দাস।

ঝুমন দাসের মুক্তির দাবিতে আজ বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন ঝুমন দাসের স্ত্রী রাই সরকার রাই। ছবি: উদীচী

সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে জামশেদ আনোয়ার তপন বলেন, ‘আপনারা ঝুমন দাসকে মুক্তি দিন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করুন। এখন পর্যন্ত ১৭৬ জন সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অপরাধ, তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে যারা দুর্নীতি করছে, লুটপাট করছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ, অন্যায় অপরাধ করছে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জনগণকে নিরাপত্তা দিতে পারেনা বলে সাংবিধানিক বরাতে তিনি বলেন, ‘এই আইন লুটপাটকারীদের নিরাপত্তা দেয়। এই স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার ও ৭২-এর সংবিধানের পরিপন্থী। তাই এই আইন বাংলাদেশে থাকতে পারে না। আমরা অবিলম্বে এই বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।’

এর আগে স্বামীর উপর মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি চেয়ে রাই সরকার রাই গণমাধ্যমে বলেন, ‘এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে আমাদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দিন। তার সাথে নাগরিক হিসেবে আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।’

ছেলের মুক্তি চেয়ে ঝুমনের মা নিভারানী সরকার দাস বলেন, ‘ছেলেকে গ্রেপ্তারের পর আমাদের ঘরসহ গ্রামের সকল বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হলো। আমার পুত্রবধূকে হেনস্তা করা হয়েছে। আর কী শাস্তি পাওয়ার বাকি আছে আমাদের?’

ঝুমন দাসের মুক্তির দাবিতে আজ বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে 'মোড়ল পুলিশিং' শিরোনামে নাটক ইন্ট্রোভাইজেশন করছে প্রাচ্যনাট। ছবি: উদীচী

ঝুমন কোনো ধর্ম, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়নি জানিয়ে সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস গণমাধ্যমকে বলেন, 'সে একজন ব্যক্তির সমালোচনা করেছে। এ কারণে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে জেলে রাখা অযৌক্তিক। আমরা তার মুক্তি চাই এবং যারা আমাদের গ্রামে হামলা ও লুটপাট করেছিল সবার গ্রেপ্তার চাই।

প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে চলতি বছরের মার্চের ১৫ তারিখ শানে রিসালত সম্মেলন নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে বক্তব্য রাখেন হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে এর আগেই সমালোচনায় ছিলেন মামুনুল হক। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় দিরাইয়ের সমাবেশে এসে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন মামুনুল।

মামুনুল হকের সমালোচনা করে এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাস আপন। স্ট্যাটাসে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ আনেন মামুনুলের বিরুদ্ধে।

ঝুমনের এমন স্ট্যাটাসে ক্ষেপে যান হেফাজত ও মামুনুলের স্থানীয়া অনুসারীরা। মামুনুলের নামে সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা ও অবমাননা বলে চালাতে থাকেন এলাকায় প্রচারণা। এতে এলাকাজুড়ে দেখা দেয় তুমুল উত্তেজনা।

ছবি: উদীচী

বিষয়টি বুঝতে পেরে গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে পুলিশের হাতে তুলে দেন ঝুমন দাসকে। হেফাজতে ইসলামসহ স্থানীয় মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ওই রাতেই স্থানীয় বাজারে বৈঠক করে প্রশাসন। এ সময় আটকের খবর জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শান্ত থাকার আশ্বাস দেন উপস্থিত সবাই।

কিন্তু সারা দেশ যখন উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত ঠিক ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। লুটপাট ও ভাঙচুর চালায় ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি ও মন্দিরে।

শাল্লার এই তাণ্ডবে অভিযোগ ওঠে- পুলিশ আগে থেকে আভাস পেয়েও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এই গাফিলতির অভিযোগের ঘটনার তদন্তে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সদর দপ্তরে ২৬ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয় এই কমিটি।

ঝুমন দাসের মুক্তির দাবিতে আজ বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে উপস্থিতির একাংশ। ছবি: উদীচী

প্রতিবেদনে হামলার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ১১ জনকে বদলি এবং ৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

ঝুমন দাসের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখি করছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে মানুষটা ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলছে তাকে এভাবে হেনস্তার বিষয়টা আসলেই দুঃখজনক। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এই মামুনুলদের মত ধর্ম ব্যবসায়ীরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে আসছে। সেখান থেকে ঝুমন দাসদের মতো যুবকরা ধর্মের নামে এসব সাম্প্রদায়ীক সমস্যা নিরসনে নিজেদের মত প্রকাশ করছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে এতটুকু অধিকার ঝুমন দাসদের মতো যুবকদের না থাকলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অচিরেই বিনষ্ট হবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক সমাজ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত