ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট

মানবাধিকার প্রশ্নে সার্বিক উন্নয়ন হয়নি বাংলাদেশের

প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২১, ২২:১৩

সজিব তুষার

যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দেশের চলমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ, গণমাধ্যমের উপর বিধিনিষেধ আরোপ, নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর সহিংসতাসহ শিশুশ্রম অব্যাহত থাকার মত বিষয় গুলো। ২০২০ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির সামগ্রিক কোনও উন্নতি হয়নি বলেও উপস্থাপন করা হয় ওই প্রতিবেদনটিতে।

২০২০ সালেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম চাপের মধ্যে ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার-হয়রানির কথাও স্থান পেয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

যুক্তরাজ্যের সংসদে ২০২০ সালের ঘটে যাওয়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সম্পর্কিত 'হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসিঃ দ্য 2020 ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস রিপোর্ট' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মৃত্যুদণ্ড, গুম ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয় গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটিতে।

মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ থাকা অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৩১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বিষেশভাবে উল্লেখ করা হয়, করোনা মহামারিতে সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা ঠেকাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহারসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং নারীদের প্রতি অব্যাহত সহিংসতার কথা।

স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বরাতে বলা হয়, গত বছর দেশে ১৬২৭ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা এসবের মূল কারণ হিসেবে দায়ী করেন কার্যকর আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতাকে।

'রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার' ও 'আর্টিকেল ১৯' নামের দুটি প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করা হয় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে। যাতে, ১৮০টি দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৫১তম স্থানে নেমে এসেছে বাংলাদেশ। যা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বনিম্ন অবস্থান। ৪৫১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। ৭৫ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে ৪১টি মামলায়। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ৩২ জন সাংবাদিক।

দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনটিতে। বলা হয়, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীদের ও ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর ব্যাপক অভিযোগ ছিল। গত নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ভোটারদের হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতারমত ঘটনা ঘটে।

বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়া ও বিদেশে না যাওয়ার শর্তে তাকে কারামুক্তি দেওয়ার বিষয় উঠে আসে। গত সেপ্টেম্বর মাসে তার কারাদণ্ডাদেশ স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়। 'হাউস অ্যারেস্ট' ছিলেন তিনি ২০২০ সালজুড়ে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বরাতে বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্ট মাসে পুলিশের হাতে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি জনগণের কাছে নজিরবিহীন গুরুত্ব পায়। এরপর বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমেছে। প্রতিবেদনে অন্তত ৩১টি গুমের তথ্যসহ ক্রসফায়ার ও নির্যাতনে বিচারবহির্ভূত ২২৫টি হত্যার জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র ইস্যুতে চলতি বছর যুক্তরাজ্য কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ও উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে কাজ করা অব্যাহত রাখবে।

প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান সাহস২৪কে বলেন, 'যেই ঘটনাগুলো প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে এটা বিদেশী কোনও মাধ্যম থেকে নতুন করে জানার কোনও প্রয়োজন নাই। আমাদের প্রতিদিনই এমনসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই। আমরা মানবাধিকার সংক্রান্ত এসব সংকট; ধনী, দরিদ্র, সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু, রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বা দূর্বল সবাই কিন্তু একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।'

অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান বলেন, 'রাষ্ট্রের কোনও পর্যায়ে ন্যায্যতা না থাকলে যা হয়- নাগরিকের কোনও অধিকার রাষ্ট্র কিংবা সরকার নিশ্চিত করতে পারে না। এবং সেটাই আসলে আমরা এই রিপোর্টের মধ্যে দিয়ে দেখেছি।’

দেশিয় প্রতিবেদন-প্রকাশনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, 'এখন মুশকিলটা হচ্ছে এই তথ্যগুলোর জন্য আমরা বিদেশি রিপোর্টের উপর নির্ভর করছি। কিন্তু এই কাজ তো দেশের মানুষেরই করা উচিৎ। আমরা কি ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। দুঃখজনক হলেও দেশিও কোনও উৎস থেকে জানতে পারলে এটা আমাদের জন্য আরও সুখের হতো।

তিনি বলেন, 'আমাদের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম আছে, এনজিও গুলো আছে; এই কাজগুলোতো তাদের থেকে আসা উচিৎ। আগে তাও কিছু এনজিওর রিপোর্ট আসতো এগুলোও এখন ঠিকঠাক সামনে আসছে না। যার ফলশ্রুতিতে দুঃখজনক যে, আমাদের এই পরিস্থিতিগুলো জানতে হয় বিদেশি প্রকাশনাগুলোর মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় যে আমরা আসলে কোন অবস্থার মধ্যে আছি। আমাদের সিভিল সোসাইটি (সুশীল সমাজ) যারা আছেন তারা যদি আরও সক্রিয় হোন তবে এই সঙ্কট নিরসন অসম্ভব নয়।'

বিদেশি প্রকাশনার প্রতিবেদনের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্যের বিষয়ে বলেন, 'এ ক্ষেত্রে অনেক সময় ঠিকঠাক তথ্য উঠে আসে না। এছাড়া এসব প্রকাশনার ক্ষেত্রে তাদের দেশিয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোই গুরুত্ব পায়। এর বাইরে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আড়ালেই চলে যায়। যেটা আমাদের গণমাধ্যম বা এনজিওগুলোও সামনে আনতে পারছে না।'

তিনি আরও বলেন, 'রাষ্ট্রীয় এসব সঙ্কটের প্রতিরোধ করার প্রথম ধাপ হচ্ছে 'সঙ্কট' জনগণের সামনে উপস্থাপন করা। জনপরিসরে মানবাধিকার লঙ্গণের ঘটনাগুলো খুবই স্বাভাবিকভাবেই ঘটছে। মানুষের কাছেও এসব খুব স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আমরা যে খুব ভালো একটা অবস্থায় আছি এমনটা বলা যায়না।'

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত