‘ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে’

প্রকাশ : ২৪ মে ২০২১, ২৩:৫৫

সাহস ডেস্ক

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশের নতুন পাসপোর্টে ইসরাইলের নাম বাদ দেওয়া হলেও দুটো দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার কারণে বাংলাদেশিরা ইসরাইলে যেতে পারবে না।

তিনি বলেন, ইসরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশ কোন ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করছে না।

আগের পাসপোর্টে ইসরাইলে ভ্রমণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু নতুন ই-পাসপোর্টে সেই কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

পাসপোর্ট থেকে ইসরাইলের নাম বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যের যৌক্তিকতা এবং ইসরাইলের প্রতি বাংলাদেশের অবস্থান নমনীয় হচ্ছে কীনা-এসব প্রশ্নে ব্যাপক আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশের পাসপোর্টে এই পরিবর্তনের বিষয়টি এমন সময় জানা গেলো, যখন সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে নতুন করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশ-সহ বিভিন্ন দেশে ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।

বাংলাদেশের পাসপোর্টে সব সময়েই ইসরাইলের নাম উল্লেখ করে বলা হতো, এই দেশ ছাড়া আর সব দেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্টটি বৈধ। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন ই-পাসপোর্টে 'ইসরাইল ব্যতীত' অংশটি বাদ দিয়ে বলা হয়েছে বিশ্বের 'সব দেশের' ক্ষেত্রে এটি বৈধ।

সাবেক একজন কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, যে সময়ে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে, এই সময় বেছে নেয়াটা ঠিক হয়নি।

তবে এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ছয় মাস আগে নতুন পদ্ধতির ই-পাসপোর্টে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।

একইসাথে তিনি অভিযোগ করেছেন, কোন মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিষয়টিকে নিয়ে নানা আলোচনা চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, নিউজটা বের করেছেন এমন সময়, যখন ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাতটা হলো। সেটা যখন তুঙ্গে, এই সময় কোন স্বার্থন্বেষীমহল এটা জোরেশোরে তুলে ধরলেন। কবে আমরা এটা করেছি। আর হঠাৎ করে এটা নিউজ হয়ে আসলো।

তিনি আরও বলেছেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কোন পরিবর্তন নাই। উই ওয়ান্ট টু স্টেট সল্যুশন। প্যালেস্টাইন তার ১৯৬৭ সালের ম্যাপ অনুযায়ী তাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে জেরুজালেমকে রাজধানী করে। এটাই আমরা বিশ্বাস করি, মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। এটাই আমরা প্রমোট করি।

তবে দেশের ই পাসপোর্টে যে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কিন্তু আগে কোন বক্তব্য বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।

ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যখন বাংলাদেশের পাসপোর্টের পরিবর্তনের বিষয় তুলে ধরে টুইট করা হয়, তার জবাবে গত রবিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বক্তব্য দেয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে গত রবিবার প্রথমে বলেছিলেন, বিষয়টি শোনার পরে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে জানতে পারেন যে, ছয় মাস আগে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছেন, এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে এক বছর আগে এবং তা বাস্তবায়ন শুরু করা হয়েছে ছয় মাস আগে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, বিষয়টা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণেও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

তিনি বলেন, সেখানে সমন্বয়ের একটা অভাব আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই কাজটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করতে পারতো। এখানে ভীষণ ঘাটতি ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার লিখিতভাবে ইসরাইলের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছিল।

সেই থেকেই বাংলাদেশ অবস্থান রয়েছে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পক্ষে। তবে গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে পাসপোর্টে পরিবর্তনের ফলে ইসরাইলের প্রতি বাংলাদেশের নমনীয় অবস্থানের ইঙ্গিত কীনা- সেই প্রশ্নও উঠেছে।

সাবেক একজন পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেছেন, কোন ইঙ্গিত থাকলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় অদূর ভবিষ্যতে কূটনৈতিক নীতিতে বড় পরিবর্তন সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন আবার ইসরাইলের সাথে সম্পর্কতো অনেকে করছে। আমার মনে হয় না, বাংলাদেশ এমুহুর্তে সেটা করছে। এ ব্যাপারে আমি সরকারি ভাষ্যকেই বিশ্বাস করছি যে এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ইসরাইলে সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য এগুবে না।

তিনি বলেছেন, যদি বলেন, একটু নমনীয় হওয়া কীনা-হতে পারে। কারণ যাদের সাথে সংঘাত, সেখানে আরবদেশগুলোকে যদি একসাথে ধরি, তাহলে তারাইতো নমনীয় ভূমিকা নিচ্ছে। তাদেরকে সমর্থন করেইতো আমরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিয়েছিলাম। কাজেই পাসপোর্টে পরিবর্তনকে অনেকে নমনীয়তার ইঙ্গিত মনে করতে পারেন। কিন্তু এতে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হয় না।

বাংলাদেশের পাসপোর্টে আগে ইসরাইলের পাশাপাশি তাইওয়ান এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। অনেক আগেই সেই নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে তাইওয়ান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নাম বাদ দেয়া হয়েছে।

তৌহিদ হোসেন বলেছেন, এক সময় ছিল তাইওয়ানে যাওয়া যেত না। পাসপোর্টে সেটা বাদ দেয়ায় এখন তাইওয়ানে যাওয়া যায়। তাইওয়ানকে তো আমরা এখনও স্বীকৃতি দেইনি। তবে এখন প্রয়োজনে এবং ব্যবসায়িক কারণে অনেকে তাইওয়ান যান। এক সময় হয়তো ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের সে রকম একটা যোগাযোগ হতে পারে। সেটা সময় বলবে।

পাসপোর্টে ইসরাইলের প্রসঙ্গ বাদ দেয়া হলেও দেশটিতে বাংলাদেশিরা যেতে পারবেন না বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, যেহেতু ঐ দেশ (ইসরাইল) আমাদের দ্বারা স্বীকৃত না। আমরা তাদের (ইসরাইলকে) দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেই না। সেজন্য আমরা কোনভাবেই কাউকে সেখানে যাওয়ার সুযোগ দিতে পারবো না।

তিনি উল্লেখ করেছেন, ফিলিস্তিন এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বাংলাদেশের যে নীতি আছে, তাতে বাংলাদেশ অটল অবস্থানেই থাকবে।

পাসপোর্টে ইসরাইলের প্রসঙ্গ বাদ দেয়ার ঘটনাকে তিনি প্রশাসনিক এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার বিষয় বলে তুলে ধরেন। কিন্তু ই-পাসপোর্ট প্রথমদিকে যাদের দেয়া হয়েছে, তখন ইসরাইলের প্রসঙ্গ বাদ দেয়া হয়নি।

বাংলাদেশের পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ই-পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার বিষয়টি ইসরাইলের নাম উল্লেখ থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করে না বলে তিনি মনে করেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত