ভাসানচরে ভালো আছেন রোহিঙ্গারা, ফিরতে চান মিয়ানমারে

প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০২:৫১

সাহস ডেস্ক

কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরের চেয়ে অধিকতর ভালো স্থান ভাসানচরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা তাদের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারসহ দ্রুত নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখতে চায়।

সাত হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা যারা নিরাপদ ও সুরক্ষাসহ আরও ভালো জায়গার সন্ধানে ভাসানচরে স্থানান্তরিত হয়েছেন, ফয়েজ তাদের মধ্যে একজন। ২৮ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ফয়েজ বলেন, আমরা এখানে (ভাসানচর) সুখে-শান্তিতে বসবাস করছি। এখানে যে সুবিধাগুলা পেয়েছি তাতে খুব খুশি। তবে আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।

তিনি বলেন, তিনি সবেমাত্র ভাসানচরে একটি দোকান খুলেছেন। যেখানে চা এবং নাস্তা পাওয়া যায় এবং প্রতিদিন দোকান থেকে বিক্রি করে কিছু অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে আশাবাদী।

২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে সামরিক নির্যাতনের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করা তরুণ রোহিঙ্গা বলেন, আমি এখানে আমার স্ত্রী, তিন সন্তান এবং আমার শাশুড়ির সাথে আছি। তারা আলু, চিনি, ভোজ্যতেল, লবণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ছাড়াও প্রতি মাসে মাথাপিছু ১০ কেজি করে চাল পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ বলেছে, মিয়ানমার থেকে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়ার সাথে সম্পর্কিত অসংখ্য চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ সরকারকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা করতে বাধ্য করেছে।

প্রথম ধাপে গত ৪ ডিসেম্বর ১৬৪১ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয় এবং ১৮০৪ জন রোহিঙ্গার সমন্বয়ে গঠিত দ্বিতীয় ব্যাচটি গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়।

বাচ্চাদের জন্য তৈরি বড় খেলার মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে আরও একজন রোহিঙ্গা বলেন, আমরা আসলে মিয়ানমারে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। আমরা ন্যায়বিচার চাই। আমাদের প্রাপ্য মৌলিক অধিকার ফিরে পেতে চাই এবং আমরা ঘরে ফিরতে প্রস্তুত, তবে ভাসানচরে গত ২ মাস ধরে আমরা সুখে বসবাস করছি।

তিনি বলেন, মিয়ানমারে যারা গ্রেপ্তার হচ্ছে, স্বদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের মুক্তি দেয়া উচিত। কারণ তাদের লক্ষ্য সমস্ত অধিকার ফিরে পেয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়া। ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ার পরও রফিকুলের বাবা-মা ও বোনেরা এখনও কক্সবাজারে একটি শিবিরে রয়েছেন। কারণ তারা সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় চেয়েছেন।

আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের (ভাসানচর প্রকল্প) প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, ভাসানচরে যারা ইতোমধ্যে রয়েছেন তাদের মধ্যে বাচ্চাদের সংখ্যা বেশি, বিশেষত চার থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী। সম্ভবত, কক্সবাজার শিবিরে রোহিঙ্গারা অবকাঠামো, শিক্ষার সুযোগসুবিধাগুলো এবং অন্যান্য বিষয়গুলোর তথ্য পেয়েছে যা তাদের এখানে আসতে উৎসাহিত করেছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সাথে তার আলোচনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আরও অনেক রোহিঙ্গা রয়েছেন যারা ভাসানচরে আসতে আগ্রহী, তাদের পরবর্তী ব্যাচ শিগগিরই স্থানান্তর করা হবে। শেষ স্থানান্তরটি ২৮-২৯ জানুয়ারিতে হয়েছিল।

এক প্রশ্নের জবাবে কমডোর মামুন বলেন, প্রাথমিকভাবে ২২টি এনজিও ছিল তবে বর্তমানে ৪০টিরও বেশি এনজিও ভাসানচরে কাজ করছে। আলাপকালে, দশ বছর বয়সী আমেনা খাতুন জানায়, সে তার বাবা-মায়ের সাথে এসেছে এবং তার দুই বোন এবং তিন ভাই রয়েছে যারা সকলেই ভাসানচরে রয়েছেন।

তারা রাখাইনে তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে জানিয়ে সে বলেছে, আমি একটি ছোট সুপারি পাতার দোকান চালাই। প্রতিদিন আমার বিক্রির পরিমাণ কমবেশি ২০০-৩০০ টাকা। যা আমার সামান্য আয়ের উৎস।

পরিদর্শনকালে খেলার মাঠ এবং মিনি-শিশু পার্কে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা শিশুদের খেলতে দেখা গেছে। ভাসানচর সম্পর্কে সরকার বলেছে, খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সাথে নিয়ে অনেক ভালো অবকাঠামো স্থাপন করা হয়েছে।

ব্রিটিশ সংস্থা এইচআর ওয়ালিংফোর্ড দ্বীপের স্থিতিশীলতা জরিপে জড়িত। আসলে, দ্বীপটি তাদের সুপারিশ এবং নকশা অনুযায়ী উন্নত করা হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী- এইচআর ওয়ালিংফোর্ডের নকশা করা ১২.১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং পর্যাপ্ত উচ্চতর বাঁধ দিয়ে বন্যা এবং তীর সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো এই দ্বীপটিকে বড় বড় জোয়ারের ঢেউ এবং ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করবে।

কর্মকর্তারা বলেছেন, এখানে আধুনিক হাইড্রোগ্রাফিক মনিটরিং এবং সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে যা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে আগেই প্রাথমিক সতর্কতা প্রদান করতে পারে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভাসানচরের অবকাঠামোগত কার্যকারিতা এবং শক্তি ও এর দুর্যোগ সুরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আমফান চলাকালীন পরীক্ষা করা হয়েছে।

যেকোনো মারাত্মক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া পরিচালনার কাঠামো অনুযায়ী সময়মতো সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এর আগে, মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থার অভাবের কারণে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে দুবার প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার ২০১৮ সালের ১৬ জানুায়ারি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সম্পর্কিত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ বলছে, রোহিঙ্গারা তাদের সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারছে না এবং তাদের মধ্যে আস্থা বাড়াতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দেয়। রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং বিচার ব্যবস্থাসহ একাধিক উপায়ে চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ মিয়ানমারের বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ- জাপান, চীন, রাশিয়া, ভারত এবং আসিয়ান দেশসমূহ থেকে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাব করেছিল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত