অবশেষে দায় স্বীকার করলেন সন্তান হত্যাকারী মা

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১৯:৫০

সাহস ডেস্ক

বাবা, চাচা বা ফুফা কেউ নয়, মা শান্তা আক্তার ওরফে পিংকিই হত্যা করেছে তার ১৭ দিন বয়সীয় শিশুকন্যা সোহানাকে। সকল জল্পনা কল্পনা ও নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন শান্তা আক্তার।

গতকাল শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) মোরেলগঞ্জ থানা পুলিশ শিশুর মা শান্তা আক্তারকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করলে হত্যার বর্ণনা ও দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা বলেন। পরে আদালতের বিচারক শান্তা আক্তারকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।

আজ শনিবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে বাগেরহাট জেলা পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় এসব তথ্য জানিয়েছেন।

পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমরা সোহানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, পরিবারের সঙ্গে কথোপকথন ও বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করি। আমাদের ধারণা ছিল- হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিবারের কেউ জড়িত রয়েছে। আমরা শিশুটির বাবা সুজন খানকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ এবং রিমান্ড আবেদন করি। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে সুজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আমাদের মনে হয় যে, নবজাতকের মা ও বাবাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।’

তিবি বলেন, ‘সে মোতাবেক দুইজনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শিশুটির মা আমাদের কাছে হত্যার বর্ণনা দেন। নিজেই শিশু সন্তানকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেন তিনি।’

তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) বিকেলে বাগেরহাট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ খোকন হোসেনের সামনে শিশুটির মা শান্তা আক্তার ওরফে পিংকি হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় যা আদালত রেকর্ড করেছেন।’

পুলিশ সুপার আরো বলেন, ‘একইসঙ্গে সকল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’

এদিকে, ঘটনার ভিতরের রহস্য উন্মোচন করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোরেলগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) ঠাকুর দাস বলেন, ‘হত্যার শিকার শিশুটির বাবা সুজন ও মা শান্তা আক্তার ওরফে পিংকি দুইজনেরেই আগে বিয়ে হয়েছিল। পিংকি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার বনগঞ্জ গ্রামের মোঃ ইউনুছ শেখের মেয়ে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে একই এলাকার উজ্জল ভুইয়া নামের এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেখানে পিংকির একটি মেয়ে রয়েছে। কিন্তু দুই বছর না যেতেই ২০১৯ সালের দিকে পিংকির সাথে তার বর্তমান স্বামী মোরেলগঞ্জ উপজেলার গাবতলা গ্রামের সুজন খানের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্র ধরে পিংকি তার নাম পরিচয় ও বিয়ের বিষয় গোপন করে সুজনের কাছে চলে আসেন। সুজনের বোনজামাই এনামুলের ঢাকাস্থ বাসায় বিয়ের পরে ২০ দিন থেকে সুজনের সঙ্গে তার বাড়িতে আসেন পিংকি। কিন্তু পূর্বের বিয়ে ও সন্তানের কথা এই স্বামী ও তার পরিবারের কাছে গোপন রাখেন পিংকি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা মামলার সূত্র ধরে পিংকির বাবার পরিবার, পিংকির পূর্বের স্বামী-সন্তান ও কয়েকজন আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সুজনের পূর্বের স্ত্রী ও শান্তা আক্তার পিংকির পূর্বের স্বামীসহ বিভিন্ন পারিবারিক ঝামেলার জন্য পিংকি তার সন্তানকে হত্যা করতে পারেন এমনটি ধারণা করা হয়।’

ওসি আরো বলেন, ‘পরে জিজ্ঞাসাবাদে পিংকি আমাদের আরও জানিয়েছেন- ঘটনার রাতে ঘুমানোর পরে তার শরীরে প্রচন্ড জালা শুরু হয়। এসময় নিজের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনের খাল, বাগান ও পুকুরের পাড়ে দৌড়াদৌড়ি করেন। এক পর্যায়ে ঘরের সামনের পুকুরের ঘাটে জামরুল (লকট) গাছের নিচে শিশুটিকে ফেলে দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন শান্তা আক্তার পিংকি। পরবর্তীতে রাত দেড়টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সন্তানের জন্য কান্নাকাটি শুরু করেন তিনি।’

হত্যার শিকার নবজাতক সোহানার দাদা ও মামলার বাদী আলী হোসেন বলেন, আমার সন্তান সুজন খান নির্দোষ। আমি তার মুক্তি চাই। আমি নাতিও হারালাম, আবার ছেলেও জেলে- এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

সুজনের মা নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমাদের আদরের ধন সোহানাকে হারিয়েছে। আমাদের চোখের পানি এখনও শুকায়নি। আমরা সুজনকে হারাতে চাই না। আমি সুজনের মুক্তি চাই।’

এদিকে প্রতিবেশী মরিয়ম বেগম, খলিলুর রহমান, হাসি বেগমসহ কয়েকজন বলেন- শিশুটির হারিয়ে যাওয়া ও মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে আমরা খুবই চিন্তিত ছিলাম, কিভাবে ঘটনা ঘটল এসব চিন্তা করে। তবে এখন জানতে পারলাম সোহানার মা-ই হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন হওয়ায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। এ ধরণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য এই ঘটনার কঠোর শাস্তি দাবি করেন তারা।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ নভেম্বর রাতে মোরেলগঞ্জ উপজেলার গাবতলা গ্রামে বাবা সুজন খান ও মা শান্তা আক্তারের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল ১৭ দিন বয়সী শিশু সোহানা। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে তারা দেখেন যে শিশুটি সেখানে নেই, কোথাও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না, হারিয়ে গেছে। পরেরদিন ১৬ নভেম্বর ভোর থেকে পুলিশের একাধিক টিম শিশুটিকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করলেও কোনও কূল-কিনারা পাচ্ছিল না পুলিশ। ওইদিন রাতেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মোরেলগঞ্জ থানায় মামলা করেন শিশুটির দাদা আলী হোসেন খান। এর দুইদিন পর বুধবার ভোরে ফজরের নামাজের পর নিজ ঘরের সামনের পুকুরে নাতির মরদেহ ভাসতে দেখেন আলী হোসেন। পরে পুলিশ শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য বাগেরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত