ডিমলায় ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যু

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২০, ১৩:৫৫

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ী ইউনিয়নের অনুমোদনহীন অবৈধ নাম সর্বস্ব  শুটিবাড়ী সেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই শিউলী আক্তার নামের এক অন্তঃসত্তা নারীকে শারীরিক নির্যাতন করে ভুল  চিকিৎসা দেয়া ও প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের দ্বায়িত্বে অবহেলাসহ স্বেচ্ছাচারিতায় নবজাতকের মৃত্যু  এবং প্রসূতির গোপনাঙ্গের কাটা সাইড সেলাই না করার ঘটনায় এলাকা জুড়ে  তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে ওই প্রসূতি অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের কারনে গুরুত্বর অসুস্থ অবস্থায় উপজেলা  সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় বুধবার(১১মার্চ)রাতে অসুস্থ  প্রসূতির পিতা শহর আলী ক্লিনিকের মালিক কর্তৃপক্ষ,অনভিজ্ঞ নার্স ও আয়া সহ  পাঁচজনের বিরুদ্ধে ডিমলা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন । অভিযুক্তরা হলেন-উক্ত  ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারটির মালিক মোস্তাফিজার রহমান খন্দকার ওরফে  মতিয়ার(৩৮)আব্দুল্লাহ আল মামুন(৫০)শিক্ষক চিত্তরঞ্জন রায়(৫২),নার্স শারমিন  আক্তার(২৪),আয়া রশিদা বেগম(৩৮)।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে,টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিন খড়িবাড়ী গ্রামের শহর  আলীর কন্যা শিউলী আক্তার(২১)সাথে দুই বছর পুর্বে একই ইউনিয়নের পশ্চিম  খড়িবাড়ী গ্রামের আনছার আলীর পুত্র রানা হোসেনের(২৫)বিয়ে হয়।বিয়ের পর 

অন্তঃসত্ত্বা শিউলি আক্তারের সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসায়  মঙ্গলবার(১০মার্চ)সকালে তার প্রসব ব্যথা শুরু হলে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে  কাছে হওয়ায় শুটিবাড়ী সেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে সিজারিয়ানের জন্য  নিয়ে যান।

এ সময়ে অন্তঃসত্ত্বা রোগী দেখা মাত্রই ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারটির একাংশের  মালিক মোস্তাফিজার রহমান খন্দকার ওরফে মতিয়ার ,নার্স শারমিন ও আয়া রশিদা  বেগম তড়িঘড়ি করে সিজারিয়ানের কথা বলে অন্তঃসত্ত্বা শিউলি আক্তারকে দ্রুত ভ্যান  থেকে নামিয়ে সোজা অপারেশন(ডেলিভারি) রুমে নিয়ে গিয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসক না  থাকার পরও অধিক মুনাফার লোভে জোর পুর্বক সিজারিয়ান ব্যতিত ফরসেপ  ডেলিভারি করতে পেটে প্রচুর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এতে অন্তঃসত্ত্বা শিউলী অসহ্য  ব্যথা সহ্য করতে না পেরে তাদের বাধা দিলে নার্স ও আয়া তার গালে ও পিঠে  চর-থাপ্পর মেরে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে জোরপুর্বক জরায়ুতে আঘাত করে এবং  গোপনাঙ্গের সাইড কেটে পুনরায় পেটে চাপ দিয়ে বাচ্চা প্রসব করতে গেলে নবজাতক  পুত্র সন্তানটি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গর্ভেই মৃত্যুবরন করেন।পরে প্রসূতি শিউলী আক্তারের কেটে  ফেলা গোপনাঙ্গের সাইডে সেলাই না দিয়েই দ্রুত মৃত নবজাতক শিশু সন্তানটিকে দীর্ঘ  এক ঘন্টা অন্য একটি রুমে রাখার পর ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে  সুকৌশলে প্রসূতি শিউলীর স্বজনদের নবজাতক শিশুটির অবস্থা সংকটাপন্ন জানিয়ে দ্রুত  রংপুর মেডিকেল কলেজ(রমেক)হাসপাতালে নিতে বলেন। তাদের কথা মত স্বজনেরা  রমেক হাসপাতালে নবজাতক শিশুটিকে নিলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক  নবজাতকটি পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গর্ভে মৃত্যুবরন করেছে মর্মে  নিশ্চিত করেন।

মৃত নবজাতককে নিয়ে প্রসূতির স্বজনরা আবারও রংপুর হতে ফিরে ওই ক্লিনিক এন্ড  ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে গিয়ে সিজারিয়ান না করা সহ নবজাতকের মৃত্যুর কারন জানতে  চাইলে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাদের এখানে নবজাতক জীবিত ছিলেন বলে প্রসুতিকে ছাড়পত্র  প্রদান করেন ও মৃত নবজাতক শিশুটিকে দ্রুত দাফন করতে চাপ প্রয়োগ করেন। 

ঘটনারদিন বিকেলে মৃত নবজাতক শিশুটিকে দাফন করার পর রাতেও প্রসূতি শিউলীর রক্তক্ষরন বন্ধ না হওয়ায় ও গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে তার পরিবারের লোকেরা ডিমলা উপজেলা সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। সেই সময়ের  হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্স সাবিনা বেগম ও সুমাইয়া আক্তার শিউলীর কাটা গোপনাঙ্গের সাইডে সেলাই না করার বিষয়টি নিশ্চিত করে কাটা সাইডে তারা ১০টি  সেলাই দিয়ে চিকিৎসা দেন।

এদিকে এলাকাবাসীর অভিযোগ, ডিমলা উপজেলা জুড়ে প্রশাসনের নাকের ডগার উপর  ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা নাম সর্বস্ব একাধিক অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক  সেন্টার গুলোতে একের পর এক ভুল রিপোর্টে রোগী প্রতারিত ও  ভুল চিকিৎসায়  কখনো নবজাতক ও কখনো প্রসূতির মৃত্যুর তালিকা দিনে-দিনে দীর্ঘ হলেও প্রশাসনের  পক্ষ হতে তা প্রতিরোধে অজানা কারনে দৃশ্যমান কোনো তদারকি এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ  গ্রহন করা হয়নি। এমনকি অবৈধভাবে বছরের পর বছর ওইসব ক্লিনিক ও  ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসলেও সেগুলোতে  নিয়মিত ভাম্যমান আদালত পরিচালনাও করা হয়না। স্থানীয় অনেকের অভিযোগ, ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা নেয়া থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও কর্মসুচিতে ওইসব অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলো থেকে প্রশাসন অনেক  সময় চাঁদা নেয়ার কারনেই তাদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেননা। আর এ জন্যই অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার মালিক কর্তৃপক্ষ যত্রতত্র ভাবেই গোজামিল দিয়ে দেদারছে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।এ যেনো সর্ষের মধ্যেই ভূত! তাই এলাকাবাসী এসব অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টি সেন্টারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে অচিরেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ জোর দাবি জানান।

শুটিবাড়ী সেবা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারটির একাংশের মালিক মোস্তাফিজার রহমান খন্দকার ওরফে মতিয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ক্লিনিকটি অনুমোদন না থাকলেও অনলাইনে আবেদন করা রয়েছে। রোগীর কাটা সাইড সেলাই করা হয়েছে কিনা তা আমি জানিনা নার্সের কাছে জানতে হবে। তবে নবজাতক শিশুটি আমার ক্লিনিকে থাকা অবস্থায় জীবিত ছিল।

নবজাতকটি জন্মে পর তার ওজন কতটুকু ছিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,মরা বাচ্চাকে কেউ ওজন করে নাকি?

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিমলা থানার ওসি মফিজ উদ্দিন শেখ অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন,আমরা বিষয়টি তদন্ত শুরু করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করব।

ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সারোয়ার আলম বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

নীলফামারী সিভিল সার্জন ডাঃ রনজিত কুমার বর্মণ এই প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি আমি জানিনা,ভুক্তভোগীর পরিবারের উচিৎ অভিযোগ নয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরাসরি  মামলা করে দেয়া। আমি জেলার অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলো বন্ধ করে দিতে এবং সেগুলোতে নিয়মিত প্রশাসনের অভিযান পরিচালনা করতে তালিকা সহ অনেকবার জেলা প্রশাসকের কাছে ধর্না দিয়েও কোনো সুফল পাইনি। আমাকে ভুক্তভোগীর পরিবার লিখিত অভিযোগ দিলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহন করব।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক(ডিসি) হাফিজুর রহমান চৌধুরী এই প্রতিবেককে বলেন, আপনারা সিভিল সার্জনকে জানান। ওনারা(সিভিল সার্জন)আমাদের তালিকা দিলে আমরা সেগুলো বন্ধ করে দিব।

সিভিল সার্জন একাধিক বার অভিযোগ করেও সুফল পাননি বলে জানিয়েছেন জানালে তিনি(ডিসি)বলেন, সিভিল সার্জন হলেন মেম্বার সেক্রেটারি তাকে এ বিষয়ে য়ে এগিয়ে আসতে হবে, তিনি অলিখিত ভাবে মুখে বললে হবেনা, লিখিত তালিকা দিলে আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সে গুলো বন্ধ করে দিব। এ ছাড়াও ভুক্তভোগীর পরিবার আমার কাছে লিখিত অভিযোগ করলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করব।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত