গণপিটুনি: আইন যা বলে

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০১৯, ১৬:৩১

জহিরুল ইসলাম মুসা

শুধুমাত্র সন্দেহ করে সবাই মিলে পিটিয়ে জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে। সরাসরি হত্যাকান্ডে খুব সক্রিয়ভাবে আগ্রহ নিয়ে শামিল হয় জনতা। এমনসব ঘটনাকে স্রেফ 'দুঃখজনক' বলার সুযোগ নেই। ছেলেধরা সন্দেহে গত কয়েক দিনে অগুনতি উপস্থিত জনতা মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে নারীসহ কয়েকজনকে। সবাই মিলে উৎসব করে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়ার আক্রোশে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে ফৌজদারি অপরাধে। বিষয়টি যতটা না আইনি সমস্যা তার চেয়ে বেশি সামাজিক সমস্যা আকারে হাজির আমাদের দেশে।

ছেলেধরা হতে পারেন, চোর হতে পারেন, ডাকাতি করতে পারেন- এরকম নানারকম অদ্ভুত সন্দেহে নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। ভাবা যায়, স্রেফ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পিটিয়ে মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে? যাদের মেরে ফেলা হচ্ছে তারা কখনো শিশু, নারী, যুবক, বয়স্ক, ছাত্র-তালিকা অনেক লম্বা। আর এমনসব গর্হিত কাজে অংশ নেয় শত শত মানুষ। নিরপরাধ কয়েকজন নারীকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে সম্প্রতি। পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে যুবক, শিশু। প্রতিনিয়ত ঘটছে এমনসব ঘটনা। বছর কয়েক আগে সাভারের আমিন বাজারে ৬ জন নিরপরাধ ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলার কথাও ভোলার নয়।

যদিও বাংলাদেশের আইনে এমন কোনো সুযোগ নেই যে, ডাকাতি, চুরি, ছেলেধরা বা অন্য কোনো অপরাধ করতে পারে এমন সন্দেহে- কিংবা অপরাধ করার পরও আইনের আশ্রয় না নিয়ে অপরাধীকে মেরে ফেলা যায়। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো; 'গণপিটুনি'তে অংশ নেয়ার অপরাধে বাংলাদেশে কারও দন্ড হওয়ার নজির বাংলাদেশের আদালতে বিরল।

'হাতেনাতে ধরা পড়া'র পর কিংবা স্রেফ সন্দেহ করেই কাউকে অপরাধী বলে তাৎক্ষণিক জনমত তৈরি করে পরে গণপিটুনি দেয়াটা মোটামুটি বাংলাদেশের সমাজে একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। 

যদিও এই ইদানীং এসব মৃতু্যতে সামাজিক প্রতিক্রিয়া যে শুধু আগের মতো 'গণপিটুনি'র পক্ষে একতরফা যাচ্ছে না তা স্পষ্ট। তবে এর জন্য বরাবরের মতো 'পুলিশের কাছে গেলে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা' কিংবা 'এটা হলো আইনের প্রতি আস্থাহীনতার' ফল জাতীয় অবস্থান যে নাগরিকদের একাংশ নিচ্ছেন- তাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, রাষ্ট্রে আইনের প্রয়োগ যেসব কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে তার অন্যতম হলো এভাবে 'বিচার বহির্ভূতভাবে' দন্ড আরোপ করা।

যাব কিংবা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ড এবং হত্যাকান্ডের চেয়ে সাধারণ নাগরিকদের কর্তৃক এমন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড কোনো অংশেই কম বিপজ্জনক নয়। অনেক ক্ষেত্রে বরং বেশি বিপজ্জনক। কারণ, গণ অংশগ্রহণের কারণে এমন হত্যাকান্ডে সামাজিক সমর্থন তৈরি হয়। 'হাতেনাতে' ধরে ফেলা ডাকাত বা পকেটমারদের হত্যাকান্ডে সহানুভূতির মধ্যদিয়ে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে যে, এসব হত্যাকান্ডের পরও সমাজে 'মিশ্র' প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। যদিও সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে এমন বিচার বহির্ভূত কাজকে অপরাধ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

দেশের বর্তমানে কার্যকর সংবিধানের তৃতীয়ভাগে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভ, আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, চোর ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। আর এর ব্যতিক্রম করলে দন্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী আপনাকে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা পুলিশের আইনগত দায়িত্ব। আর এ দায়িত্বে বাধা দেয়ার মতো কোনো অধিকার আপনার নেই। বরং এমন কোনো ব্যক্তিকে আপনি যদি আটকে রাখেন এবং পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তবে আপনাকে দন্ডবিধির ১৮৬ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০ টাকা জরিমানা বা দুই ধরনের দন্ডেই দন্ডিত হতে পারেন।

আটক রাখার পর যদি ওই ব্যক্তিকে পিটুনি বা ধোলাই দেন তবে কারাদন্ডে মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা তো থাকছেই। আঘাত করতে গিয়ে যদি গুরুতর আঘাত দিয়ে ফেলেন তবে ৩৩৪ ধারা দন্ডবিধি অনুযায়ী কারাদন্ডের মেয়াদ বাড়বে আরও এক বছর। আর অর্থদন্ড হবে অনূর্ধ্ব ২ হাজার টাকা। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও কারাদন্ড ও অর্থদন্ড উভয় দন্ডেও দন্ডিত হতে পারেন। (দন্ডবিধি, ৩৩৫ ধারা)

যেই ব্যক্তির ওপর এভাবে আপনি হামলে পড়লেন তার মৃতু্য হলে, দন্ডবিধির ৩০৪ ধারার বিধান অনুযায়ী আপনার দশ বছর কারাদন্ড বা জরিমানা বা দুটি দন্ডই হতে পারে। আর যদি অপরাধীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলার বিষয়টি প্রমাণিত হয় তবে দন্ড হল যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব দশ বছর মেয়াদের যে কোনো কারাদন্ড। তার সঙ্গে যে কোনো পরিমাণ জরিমানা তো থাকছেই। (৩০৪ ধারা দন্ডবিধি, প্রথম অংশ)।

গণপিটুনিতে যদি ওই ব্যক্তি নিহত হয় তবে তার দায় বর্তাবে অপরাধ সংঘটনকারী সব ব্যক্তির ওপর। কেননা আইনে 'যৌথ দায়িত্বশীলতা' বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন। তাই গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে, সবাইকে সমভাবে এজন্য দায়ী করা যাবে। [৩৪ ধারা দন্ডবিধি]

কাজেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় জড়িত জনতার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হলে সবারই নূ্যনতম দন্ড হওয়ার কথা 'যাবজ্জীবন কারাদন্ড'। কিন্তু হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া এসব উৎসুক জনতা আদালতের আগেকার নজিরের দিকে তাকিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, অভিযোগ-তদন্ত-বিচার-সাক্ষ্যের লম্বা পথ পেরিয়ে তাদের শাস্তি দেয়া এত সহজ নয়। কিন্তু কখনো না কখনো তো শুরু হতেই হবে। সেই লম্বা পথের পথচলা অন্তত এবার শুরু হোক।

লেখক : জহিরুল ইসলাম মুসা
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত