ছাদবাগানে টবে শসা চাষ

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২১, ১৮:৫৪

সাহস ডেস্ক
আলোকচিত্র :সংগৃহীত
আমাদের ডায়েট চার্টে ব্যবহৃত সবজির মধ্যে অন্যতম একটি সবজি হলো শসা। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই এই সব্জিটি অনেক পছন্দ করে থাকে। এই সবজিতে অনেক পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। এর বৈজ্ঞানিক নাম Cucumis sativus। এটি কিউকারবিটাসিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। শসা দেখতে কিছুটা বেলনাকার এবং বাইরে গাঢ় সবুজ ভিতরে সাদা ও বীজে ভরা, মাঝে মাঝে পাকলে ভিতরে লাল হয়ে যায়।
 
সূচি :
  • পুষ্টি উপাদান
  • স্বাস্থ্য গুণাগুণ 
  • ব্যবহার
  • জাত
  • উপযুক্ত সময়
  • চাষ পদ্ধতি
  • যত্ন-আত্তি
  • ফসল সংগ্রহ
 
পুষ্টি উপাদান :
  • শসার প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে থাকে-
  • জলীয় অংশ – ৯৬%
  • আমিষ – .৬ গ্রাম
  • শ্বেতসার – ২.৬ গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম – ১৮ মিঃ গ্রাম
  • লৌহ – ০.২ গ্রাম
  • ক্যারোটিন – ৪০ মাইক্রোগ্রাম
  • ভিটামিন-সি – ১০ মিঃ গ্রাম
স্বাস্থ্য গুণাগুণ :
শসায় ক্যলরির পরিমাণ কম হলেও এতে পানির পরিমাণ অনেক বেশি ও প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে। শসার ছোলা সহ খাওয়া আরো বেশি ভালো, কারণ শসার খোসায় আরও বেশি ভিটামিন রয়েছে।
শসায় রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমনঃ ফ্লেভনয়েডস, ট্যানিন্স যা দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
শসায় ৯৬% রয়েছে জলীয় অংশ যা শরীর হাইড্রেট করতে সাহায্য করে।
ওজন কমাতে সাহায্য করে কেননা এতে ক্যালরির পরিমাণ অনেক কম। তাই যারা মনে করে পেট বড় হয়ে যাচ্ছে বা শরীর মুটিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতিদিন নিয়মিত শসা খাওয়া উচিত।
শসা রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে এছাড়া ডায়বেটিস রোগের জটিলতা প্রতিকারে সাহায্য করে।
শসায় আছে প্রচুর পরিমাণে পানি ও আশঁ যা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে এবং হজমে সাহায্য করে।
 
ব্যবহার:
শসা প্রধানত সালাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও একে সবজি হিসেবে বিভিন্ন তরকারি যেমন চিংড়ি বা ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা হয়ে থাকে। অনেক দেশে একে আচার বানিয়ে সংরক্ষণ করে থাকে। আর বিভিন্ন ফাষ্টফুড বার্গার, স্যান্ডউইচে শসার স্লাইস ব্যবহার করা হয়ে থাকে।এছাড়া মেয়েরা ঘরোয়া রূপচর্চায় মুখের প্যাক অথবা টোনার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল কমাতে শসার এক পিস স্লাইস যথেষ্ট।
 
জাত নির্বাচন:

আমাদের দেশে কিছু উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন হয়েছে যা বার মাসই চাষ করা যায়। এর মধ্যে বারি -১ অন্যতম। সম্প্রতি আমাদের দেশে হাইব্রিড জাতের শঁসার বীজ পাওয়া যায় এগুলোর মধ্যে জাপানিজ লং গ্রিণ, পূষা , স্ট্রেট এইট অন্যতম।

শসার বীজ থেকে চারা তৈরি:

ভালো চারা তৈরি করতে হলে পলিব্যাগে চারা তৈরী করা সবচেয়ে উত্তম। সেক্ষেত্রে বীজ থেকে চারা তৈরির সময় প্রথমে বীজ গুলোকে ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এরপর একটি বীজতলা তৈরি করতে হবে। এর জন্য ৬০ ভাগ দোআঁশ মাটি ৪০ ভাগ শুকনো গোবর ও অল্প পরিমাণ ছাই মিশিয়ে বীজতলা টি তৈরি করে নিন। এবার ভেজানো বীজগুলোকে নতুন তৈরি করা বীছ তলায় বসিয়ে একটি পাটের ছালা অথবা সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন। এরপর কিছুদিন ওই কাপড় বা ছালার উপর কিছু কিছু করে পানি দিয়ে যান। তিন থেকে চার দিনের মধ্যেই বীজ গুলো অঙ্কুরিত হবে। এবার নতুন গজানো বীজ গুলো তুলে আপনার তৈরি করা পলি ব্যাগ গুলোতে স্থানান্তর করুন। পলিব্যাগের মাটি ‘দোয়াশ মাটি এবং গোবর’ এর মিশ্রণ দিয়ে তৈরি হতে হবে। পলিব্যাগে থাকাকালে 10 থেকে 15 দিনের মধ্যে ছোট চারাগুলো রোপণের জন্য উপযুক্ত হয়ে যাবে।

 
টবের সাইজ :
ড্রামে বা টবে শসা চাষ করলে সর্বনিম্ন টবের সাইজ ১৮”×১৮” হতে হবে। এরকম একটি টবে ১-২ টি চাড়া রোপণ করা যাবে।
 
টবের মাটি তৈরি :
শসা চাষের জন্য মাটি তৈরির সময় টবের নিচে ২” পরিমাণ ইটের সূরকী দেবেন । এর পর মোট মাটির ২৫ ভাগ গোবর বা পাতা পচা সার ও ৭০ ভাগ দোআঁশ মাটি ও ৫ ভাগ ছাই মিশিয়ে টব বোঝাই করতে হবে। এছাড়া মাটিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক সার গুলোর মধ্যে ইউরিয়া সার ৫০ গ্ৰাম , টিএসপি ৩০ গ্ৰাম , এমওপি সার ২০ গ্ৰাম মিশিয়ে নিন। এরপর চারা রোপণ করে ড্রাম গুলো নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থাপন করুন এবং নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে রাখুন। গুল্ম জাতীয় গাছের জন্য মাচা তৈরি করে দিলে সবচেয়ে ভালো হয় । এতে ভাল ফলন পাওয়া যায়। টবে শসা চাষ পদ্ধতি।
 
পানি সেচ :
টবে শসা চাষ এর ক্ষেত্রে পানি সেচ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। শসা গাছের জন্য প্রচুর পানি প্রয়োজন হয়। এজন্য প্রতিদিন সকাল বিকেল দুই বার করে পানি সেচ দিতে হবে। তাছাড়া বাসাবাড়ির প্রতিদিনের মাংস বা মাছ ধোয়া পানি গাছে সরাসরি দিয়ে দেবেন এতে গাছের অনেক উপকার হয়। মনে রাখতে হবে কোন কারণে যদি শসা গাছে পানির অভাব হয় তবে ফলন ভালো হবে না এবং ফল ছোট অবস্থাতেই ফল ঝরে যাবে।
 
সার প্রয়োগ :
রোপণের সময় প্রয়োগ কৃত সার এর বাইরে ও নিয়মিত জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া গাছের অবস্থা দেখে ইউরিয়া ও অন্যান্য সার গাছের গোড়ার ৬” ইঞ্চি দূরে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। টবের গাছের জন্য সবচেয়ে ভালো হয় তরল সার ব্যবহার করলে। তরল সার তৈরির জন্য ২০০ গ্ৰাম সরিষার খৈল অথবা ৫০০ গ্ৰাম পরিমাণ শুকনো গোবর ২ লিটার পানিতে মিশিয়ে বার দিন রেখে দিতে হবে। এরপর রাসায়নিক সার দিতে চাইলে , ঐ তৈরি করা তরল সার এর সাথে NPK বা মিশ্র সার এক চা চামচ পরিমাণ মিশিয়ে টবে প্রয়োগ করুন। প্রয়োগের সময় গাছের গোড়া থেকে অন্তত ৬-৮” ইঞ্চি দূরে তরল সার টি প্রয়োজন মত ঢেলে দিন ।
 
রোগবালাই দমন:
শসা গাছের রোগ বালাই দমন করতে বেশ কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। সাধারনত প্রায় সব ধরনের গাছে রোগ বালাই হয়ে থাকে। এখানে শসা গাছের রোগ বালাই দমনের প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক দুটি পদ্ধতিই আলোচনা করা হলো।
 
শসা গাছের রোগ বালাই দমন এর প্রাকৃতিক পদ্ধতি :
  • আপনার শসার মাচায় পাখি বসার ব্যবস্থা করে দিন । পাখি ক্ষতিকর সব পোকা খেয়ে এর দমন করতে সহায়তা করে।
  • এছাড়া একধরনের জৈব ফাঁদ পাওয়া যায় বাজার থেকে এগুলো কিনে এনে ব্যবহার করলে অধিকাংশ পোকা মাকড় এর মধ্যে ধরা পড়ে।
  • জৈব কীটনাশক প্রয়োগ, শসা গাছের রোগ বালাই দমন করতে জৈব কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। এই ধরনের কীটনাশক নিম পাতা সেদ্ধ করে বা গাঁদা ফুলের পাতার রস থেকে তৈরি করা যায়। এছাড়া নিমের তেল স্প্রে করেও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কীট পতঙ্গ দমন করা সম্ভব। বর্তমানে বাজারে নিমের তেল কিনতে পাওয়া যায়। শসা গাছের রোগবালাই দমন।
  • বিষ টোপ ব্যবহার করেও পোকা দমন করা যায়। সে ক্ষেত্রে বিষ টোপ তৈরি করার জন্য ১০০ গ্রাম থেঁতলানো কুমড়ার সাথে ১০০ গ্ৰাম পানি দিয়ে ০.২৫ গ্ৰাম ডিপটেরেক্স মিশিয়ে এই মিশ্রণটি মাটির পাত্রে ঢেলে টপ বা ড্রামের কাছে রেখে দিন দেখবেন বিভিন্ন রকম পোকা এর মধ্যে আসবে এবং মারা পড়বে। এই বিষ টোপ এর কার্যকারিতা তিন থেকে চার দিন ধরে থাকে। চার দিন পর পর এটি পরিবর্তন করে দিতে হবে।শসা গাছের রোগবালাই দমন।
 
রাসায়নিক পদ্ধতিতে শসা লতার রোগবালাই দমন :
  • ফ্রুট ফ্লাই কচি শসা এর মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং গাছের কচি কড়া পচে ঝড়ে পরে। এই সমস্যা উপশম করতে ছাই ছিটিয়ে দিন অথবা ডায়াজেনন প্রয়োগ করুন।
  • গাছ বড় হয়েছে কিন্তু ফুল কম ধরে এরকম হলে টিএসপি ও এমপি সার প্রয়োগ করুন। গাছের বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে না এমন হলে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করুন। আপনাকে গাছের অবস্থা দেখে তার প্রয়োজন অনুযায়ী সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া ছত্রাকনাশক ব্যবহার এর প্রয়োজন হলে ডায়াজনন বা ইউনিসাফ ব্যবহার করতে পারেন।
  • শসা গাছের মাছি পোকা দমন :এই পোকা ফল ছিদ্র করে ফলের ভেতর ডিম পাড়ে এবং পরবর্তীতে ঐ ফলের মধ্যে জন্মায় এবং ফল পঁচে যায়৷ এই পোকা দমনের জন্য কচি ফল কাগজ, কাপড় বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে৷ ফল বড় হওয়ার পর যখন খোসা শক্ত হয় তখন আর এই পোকা ফল ছিদ্র করতে পারেনা ৷ ক্ষেতে পোকার আক্রমন বেশি বৃদ্ধি পেলে সাড়ে ১২ লিটার পানিতে চা চামচের ২ চামচ-পরিমাণ ডিপটেরেক্স ঔষধ মিশিয়ে স্প্রে করলে পোকা দূর হবে ৷ তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, ঔষধ-ছিটানোর কমপক্ষে ৭ দিন পর্যন্ত কোনো ফসল বাজারে বিক্রি বা খাওয়া যাবে না ৷

 

শসা লতার পাউডারিমিলিডিউ রোগ :

এই রোগে পাতার উপর সাদা পাউডার এর মত দেখা যায়, হাত দিয়ে ধরলে পাউডার এর মত উঠে আসে । এর কারণে গাছ দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং ফলন হ্রাস পায়৷ এই রোগটি দূর করতে ২ গ্রাম পরিমাণ থিয়োভিট ৮০ ডব্লিউপি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ভাল করে পাতা ভিজিয়ে দিতে হবে৷ বড় ক্ষেতে প্রতি বিঘার জন্য ১২০ গ্রাম ঔষধ দরকার৷ হবে৷ ঔষধ প্রয়োগের ১৫ দিনের মধ্যে কোন ফসল সংগ্রহ করা বা খাওয়া যাবে না ৷

 

শসা লতার আনথ্রাকনোজ রোগ :

এই রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে পাতায় হলদে দাগ হয়, পরে দাগগুলো বাদামি বা কালো হয়ে ঐ অংশ পচে যায়৷ ফলের বাইরের আবরনে এই বাদামি দাগ দেখা যায় ও ফল পচে যায়৷ এর প্রতিকারের জন্য বীজ লাগানোর পূর্বে বীজ শোধণ করতে হবে ৷ ১ সের বীজ ২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স ২০০ নামক ঔষধ দ্বারা উত্তমরূপে মিশিয়ে নিন ৷ তাছাড়া রোগ অতিরিক্ত দেখা দিলে ডায়থেন ৪৫ গ্রাম ১০ লিটার পরিমাণ পানির সংগে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ৷ ক্ষেতে রাসায়নিক ঔষধ দেবার অন্তত সাত দিন পর্যন্ত ঐ ক্ষেতের ফসল বিক্রি অথবা খাওয়া যাবে না ৷ এই রোগ দমনের জন্য ঘরে তৈরি বোর্দ মিশ্রণ আক্রান্ত গাছে ছিটানো যেতে পারে৷ এক শতাংশ জমির জন্য এই বোর্দ মিশ্রণ তৈরির করতে সাড়ে সতেরো লিটার পানির সাথে ৩৫০ গ্রাম পাথুরে চুন ও অন্য সাড়ে সতেরো লিটার পানির সাথে ৩৫০ গ্রাম তুঁতে আলাদা আলাদা ভাবে মাটির পাত্রে মিশাতে হবে ৷ পরবর্তীকালে এই দুই মিশ্রণ পুনরায় অপর এক মাটির পাত্রে ভালোভাবে মিশাতে হবে এবং আক্রান্ত গাছে ছিটাতে হবে ৷ ১৫ দিন পর পর এভাবে নতুন মিশ্রণ তৈরি করে ছিটাতে হবে ৷ ফসল তোলার পর গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলতে হবে ৷

 

 
শসা লতার যত্ন :
  • শসা পানির প্রতি ভীষণ সংবেদনশীল। তাই মাটিতে পানির পরিমাণ কম হলেই পানি দিতে হবে।
  • প্রয়োজনে শসা গাছের চারপাশে বাউনি/চাটাই দেয়া হয়।
  • নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
  • শসা গাছের মাটি খুড়িয়ে দিতে হবে।
  • শসা গাছে সময়মত সার দিতে হবে।
  • শসা রোগবালাই এর আশ্রয়দাতা তাই প্রয়োজনে গাছে কীটনাশক দিতে হবে।
  • গাছ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য মাচা তৈরী করে দিতে হবে।
 
ফসল সংগ্রহ :
সাধারণত গাছ লাগানোর ৩-৪ মাস পরে ফসল সংগ্রহ করা হয়। শসা চাকু দিয়ে কেটে সংগ্রহ করতে হয়।
 
তথ্যসূত্র :
greeniculture.com,কৃষি বাংলা, www.aisekrishi.org,krisi barta
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত